একজোট হয়ে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চালানো একের পর এক হামলা সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির ক্ষমতায় থাকা সামরিক সরকার। দিন দিনই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে সে পরিস্থিতি।
একজোট হয়ে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চালানো একের পর এক হামলা সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির ক্ষমতায় থাকা সামরিক সরকার। দিন দিনই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে সে পরিস্থিতি। বিদ্রোহীদের কাছে জান্তা বাহিনীর প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ হারানোর খবর প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এ পরিস্থিতির মধ্যেও সীমিত ও বিকল্প পথে দেশটিতে ওষুধ রফতানি করছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন:: বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা হলো না যুবলীগ নেতার
রফতানিসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে বিদেশী মুদ্রার সংকট। সে কারণে ২০২৩ সালের মে মাস থেকে ছয় মাসের জন্য ওষুধসহ সব ধরনের পণ্য আমদানিই একপ্রকার বন্ধ রাখে দেশটির সরকার। পর্যায়ক্রমে শিথিলতা আনলেও চীনা মুদ্রায় সীমিত আমদানির অনুমতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় দীর্ঘসূত্রতা। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবেশী দেশটিতে সরাসরির পাশাপাশি ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে বিকল্প পথেও।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের অন্তত ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট ওষুধ রফতানির ৫০ শতাংশের বেশি হচ্ছে পাঁচটি দেশে। সেগুলো হলো মিয়ানমার, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন ও আফগানিস্তান।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানির অর্থমূল্য ছিল ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি হয় ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের ওষুধ। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসেই (জুলাই-মে) আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি ওষুধ রফতানি করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। আলোচ্য সময়ে বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানির অর্থমূল্য ১৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার। এর মধ্যে মিয়ানমারে রফতানি হয় ১ কোটি ৮১ লাখ ডলারের ওষুধ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য দেশটিতে ২ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের ওষুধ রফতানি হয়েছিল।
মিয়ানমারে ওষুধ রফতানির অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশটিতে ওষুধ রফতানি অব্যাহত থাকলেও সেখানকার আমদানি অনুমতি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা ও আমদানি সীমিত করে রাখা হয়েছে। তার পরও কম-বেশি ওষুধ রফতানি হচ্ছে মিয়ানমারে। দেশটির ওষুধ আমদানিসংশ্লিষ্ট সংগঠনও এ বিষয়ে তাদের সরকারের সঙ্গে বারবার দেনদরবার করছে।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মো. আমিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নত হলেও স্বাভাবিক হয়নি। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশটিতে ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সে দেশের সরকার ওষুধ আমদানির অনুমতি সীমিত করে দিয়েছে। আমদানিকারক যখন বাংলাদেশের রফতানিকারকের কাছে অর্ডার প্লেস করতে চায়, আগে অনুমতি নিতে হয়। খুব সম্ভবত ডলারের সংকট থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ। আমদানির অনুমতি নিয়ে আমাদের খুব ভোগান্তি হচ্ছে। বাংলাদেশের সব কোম্পানিকেই এ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে আমদানির অনুমতি চাওয়া হচ্ছে ৫ লাখ ডলারের, অনুমতি পাওয়া গেল ১ লাখ ডলারের।’
মিয়ানমারে ওষুধ রফতানি করে থাকে অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেডও। প্রতিষ্ঠানটির রফতানিসংশ্লিষ্টরাও মিয়ানমারে ওষুধ পাঠানোয় প্রতিবন্ধকতার তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলছেন, দেশটির ওষুধ আমদানি ছয় মাসের মতো প্রায় বন্ধ ছিল। এখন আমদানি কিছুটা উদার হলেও নানা রকম বাধা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে।
অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেডের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. পারভেজ রানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিয়ানমারে সংকটের শুরুতে সমস্যা ছিল না। এমবার্গোর (নিষেধাজ্ঞা) কারণে দেশটির বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভের সংকট রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানিও সীমিত করা হয়েছে। আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। গত বছরের মে মাস থেকে ছয় মাসের মতো ওষুধসহ সব ধরনের পণ্যের আমদানি একেবারেই বন্ধ ছিল। পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত করা হলেও আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতা ও রেশনিং করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে আমদানির অনুমতি চাওয়া হলেও তা পাওয়া গেছে ২০২৪ সালে এসে। আবার অনুমতি দিলেও বলা হচ্ছে চীনা মুদ্রায় আমদানি করতে। তাছাড়া যে পরিমাণ আমদানির অনুমতি চাওয়া হয়, সে পরিমাণ অনুমতি না দিয়ে অর্থমূল্য সীমিত করে দিচ্ছে। গত মাস থেকে অবশ্য কিছুটা উদার হওয়ার চেষ্টা করছে দেশটির সরকার।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতির ফলে ওষুধ রফতানি ও দেশীয় বাজারের আকার প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে। দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্তত ৫০টি বড় অংকের রফতানি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। এশিয়ার ৪৩টি, দক্ষিণ আমেরিকার ২৬টি, উত্তর আমেরিকার ছয়টি, আফ্রিকার ৩৯টি, ইউরোপের ৩৮টি ও অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, শ্রীলংকায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ১৯ লাখ ডলারের ওষুধ রফতানি হয়। গত অর্থবছরের ১১ মাসে হয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয় ১ কোটি ৫২ ডলারের ওষুধ। গত অর্থবছরের ১১ মাসে দেশটিতে ওষুধ রফতানি ২ কোটি ১৯ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানির প্রবৃদ্ধি মোট ওষুধ রফতানির প্রবৃদ্ধিতেই বড় ভূমিকা রেখেছে।
ফিলিপাইনে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওষুধ রফতানি হয় ১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের, যা গত অর্থবছরের ১১ মাসে হয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখ ডলার। আফগানিস্তানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওষুধ রফতানির অর্থমূল্য ছিল ১ কোটি ৬ লাখ ডলার। পরের অর্থবছরে অবশ্য তা কমে এসেছে, ১১ মাসে রফতানি হয় ৮৯ লাখ ডলারের ওষুধ।
পাঠকের মতামত